Monday, October 24, 2016

শিল্পায়নে সম্ভাবনাময় ভোলা জেলা

“ধান সুপারী গোলা, এই তিনে ভোলা ” দেশের একমাত্র উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলাকে চিনতে একসময় এমন প্রবাদই প্রচলিত ছিলো। কিন্তু কালের বিবর্তমানে ভোলার পরিচয় আর ওই তিনে সিমাবদ্ধ নেই, ভোলার অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ এই জেলাকে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রায়, খুলে দিয়েছে হাজারো সম্ভাবনার দ্বার। ফলে ভোলার কৃষি নির্ভর অর্থনীতির পালে লেগেছে শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া।

ইতোমধ্যেই দেশের বড় বড় শিল্পদ্যোক্তাদের পদচারনা শুরু হয়েছে ভোলায়। বিশেষ করে গ্যাস ভিত্তিক শিল্পস্থাপনে আগ্রহীরা ইতোমধ্যেই ভোলার মাটিতে পা রাখতে শুরু করেছেন। ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি দেশের ছোট বড় ৫০ শিল্প উদ্যোক্তাদের এক কর্মশালা ভোলায় অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় এফবিসিসিআই, বিজিইএমএ চেয়ারম্যানসহ ৩৫ জন শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পপতিরা অংশ নেন। বিনিয়োগ বোর্ড ভোলায় মাঝারী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নিয়ে ওই কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালার উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। ভোলায় পর্যায়ক্রমে শিল্প কারখানা, হেলিপেড, সিএনজি ষ্টেশন, সার কারখানা, নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ গ্যাস চালিত সকল ধরনের শিল্প কারখানা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে বলে বাণিজ্যমন্ত্রী ওই কর্মশালায় ঘোষনা দেন।

এর পরই এ জেলায় শিল্পকারখানা গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন শিল্পউদ্যোক্তারা। ইতিমধ্যে কাজী ফামর্স লিঃ ভোলার চরসামাইয়া এলাকায় কারখানা স্থাপন করে উৎপাদন শুরু করেছে। একই স্থানে তৈরী হচ্ছে একটি অট রাইস মিল। পাশাপাশি প্রান গ্রুপ, যমুনা গ্রুপের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান গুলো ভোলায় বিনিয়োগের ইচ্ছা পোষন করে। এছাড়া ছোট বড় আরো কিছু প্রতিষ্ঠান ভোলায় আসার কথা চিন্তা করছে। তবে যে যত আগে আসতে পারবে তাদের সুবিধাও তত বেশী হবে।

১৮৪৫ সালে নোয়াখালীর অধীনে ভোলা মহকুমা সৃষ্টি হয়। ১৮৬৯ সালে ভোলাকে বরিশাল জেলার অধীনে নেয়া হয় এবং ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ভোলা জেলা ঘোষিত হয়। প্রায় ২১ লক্ষ মানুষের বাসস্থল ভোলার মোট আয়তন ৩৫৮২ দশমিক ২০ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের দিক থেকে ভোলা জেলা দেশের ১৪ তম অবস্থানে রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন খাদ্যশষ্য উৎপাদনকারী জেলা ভোলা।
শিল্পদ্যোক্তাদের দৃষ্টিতে কারখানা স্থাপনের জন্য যে সব বিষয় গুলো খুবই গুরুত্বপুর্ন তা হচ্ছে- জ্বালানী শক্তি অর্থাৎ (১)গ্যাস (২) বিদ্যুৎ (৩) সস্তাশ্রম (৪) নিরাপত্তা এবং (৫) উৎপাদিত পন্য ও কাচামাল পরিবহনে সহজ যোগাযোগ। সম্ভাব্য এইসব সুচকের সব গুলোতেই ভোলা দেশের যে কোন জেলার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।

গ্যাসঃ সারা দেশে যখন গ্যাস সংকটের কারনে শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার পথে তখন ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্রের বিশাল গ্যাস ভান্ডার অব্যহৃত পরে আছে। এই গ্যাস ক্ষেত্রের ৩টি কুপ গ্যাস সরবরাহের জন্য সম্পুর্ন প্রস্তুত থাকলেও ব্যবহারের ক্ষেত্র না থাকায় মাত্র ১টি কুপ দিয়ে সামান্য পরিমান গ্যাস তোলা হচ্ছে ব্যবহারের জন্য। ভোলা জেলা দেশের মুল ভূভন্ড থেকে বিচ্ছিন্নতার কারনে এখানের গ্যাস পাইপলাইনে অন্যত্র নেয়া সহজ নয়। লাইনস্থাপনের উচ্চ ব্যয়ের কারনে সেটা লাভজনক হবেনা বলেই ভোলার গ্যাস ভোলায় ব্যবহারের পক্ষেই মত দিয়েছেন জ্বালানী বিশেষজ্ঞগন। এর ফলে শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস ভিত্তিক যে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দির্ঘদিন নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে।

বিদ্যুৎঃ গ্যাসের পরেই আসে বিদ্যুৎের প্রশ্ন। অতিসম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা থেকেই ভোলার বিদ্যুতের অবস্থা বোঝাযায়। গত ১ নভেম্বর ২০১৪ তারিখ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একযোগে সারা দেশের ৬৩ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ভোলার মানুষ জানতেই পারেনি সারাদেশ অন্ধকার। অনেক জেলা থেকে সতীর্থ সাংবাদিকরা ফোন করে জানতে চেয়েছে সারা দেশে যখন বিদ্যুৎ নেই তখন ভোলায় বিদ্যুৎ পাচ্ছি কিভাবে? হ্যা এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের ভোলার গ্যস ভিত্তিক ৩৪ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারনে। এখন ২২৫ মেঘাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাস ভিত্তিক ১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে। ২ হাজার ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইতিমধ্যে জাতীয়গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছে। পাশাপাশি আরো ১টি ২২৫ মেঘাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন একনেকে পাশ হয়েছে। ফলে ভোলার শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ সংকটের কোন সম্ভাবনা নেই।

সস্তাশ্রমঃ প্রায় ২১ লক্ষ জনবসতির ভোলায় বেকার সমস্যা প্রকট। ভোলার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির কারনে পুরুষ শ্রমিকদের মৌসুম ভিত্তিক কাজ থাকে, বাকী সময় তারা বেকার। জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় বিপুল সংখ্যক জেলের বছরে ৮মাস কোন কাজ থাকেনা। ফলে সস্তা শ্রমিক পাওয়া সহজ। সামাজিক কারনে কর্মক্ষেত্রে ভোলায় নারী শ্রমিক দেখা যায়না। ঘরে বসে অলস সময় কাটানো ছাড়া শ্রমঘন কোন কাজে নারীদের উপস্থিতি নেই বল্লেই চলে। প্রিয় অটোমেটিক ব্রিকসের মতো ২/১ টি প্রতিষ্ঠান সবেমাত্র নারী শ্রমিক কাজে লাগাতে শুরু করেছে। ভোলার বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিক রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গামেন্টস সহ নানা শিল্পকারখানায় কাজ করছে। ফলে ভোলায় শিল্পকারখানা হলে অন্যান্য জেলায় কর্মরত শ্রমিকদের পাশাপাশি ভোলার কর্মহীন নারী শ্রমিকদের কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

যোগাযোগঃ ভোলা দ্বীপজেলা হলেও এখন আর বিচ্ছিন্ন জেলা নয়। ভোলা-বরিশাল এবং ভোলা- লক্ষীপুর ফেরী চালুর মধ্যদিয়ে শুধু ভোলাই নয় দেশের দক্ষিনাঞ্চলীয় ১৬ জেলার সাথে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্রগ্রামসহ দেশের মুল ভূখন্ডের সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে ভোলা থেকে প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দরের দুরত্ব রাজধানী ঢাকা থেকেও কম। ভোলার চরকুকুরী থেকে নৌ পথে চট্রগ্রামের দুরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। ফলে ভোলায় শিল্পের কাচামাল আনা এবং উৎপাদিত পন্য রপ্তানী করা খুবই সহজ এবং সাশ্রয়ী হবে। এছাড়া খুব শিগ্রই সড়ক পথে দুটি সেতুর মাধ্যমে ভোলাকে বরিশালে সাথে যুক্ত করা হচ্ছে।

নিরাপত্তাঃ দেশের যে কোন জেলার তুলনায় ভোলার আইনশৃখ¥লা পরিস্থিতি ভালো। চাদাবাজী, ছিনতাই, অপহরন এই জেলায় নেই । প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের দায়ীত্বশীল ভুমিকার কারনে রাজনৈতিক সহিংসতা ভোলায় নেই বল্লেই চলে। এখানে কারখানা স্থাপনে কাউকে চাঁদা দিতে হয়না। পন্য পরিবহনেও কোন ছিনতাই ঝুকি নেই, নেই অপহরন বা মুক্তিপনের আশংকা।

এছাড়াও ভোলার আভ্যন্তরীন যোগাযোগ ব্যাবস্থা উন্নত হওয়ার কারনে সহজেই যে কোন স্থানে চলাচল করা যায়। অন্যদিকে শিল্পোন্নত যে কোন জেলার তুলনায় ভোলায় কম মূল্যে সহজে শিল্পকারখানার জন্য জমি পাওয়া সম্ভব।

সব মিলিয়ে বলা যায় ভোলা জেলা এখন শিল্পসম্ভাবনার জেলা। শিল্পকারখান স্থাপনের জন্য যে সব সুযোগ সুবিধা দরকার তার সবই ভোলায় রয়েছে এবং দেশের যেকোন স্থানের চেয়ে বেশী রয়েছে। এখন সুধু প্রয়োজন উদ্যক্তাদের এগিয়ে আসা। যে প্রতিষ্ঠান যত আগে আসবে সংগত কারনেই সে তত কম দামে জমি পাবে , শ্রমিকপাবে , অন্যান্য সুবিধাও বেশী পাবে। সম্ভাবনাময় এই দ্বীপজেলা ভোলা আগামী দিনে দেশের অন্যতম শিল্পনগরীতে পরিনত হবে এমন স্বপ্ন দেখে ভোলার প্রতিটি মানুষ। সেই দিনের অপেক্ষায় আমরাও।